'ক্রলিং পেগ' বা বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার বাস্তবায়ন ও বৈশ্বিক সুদের হার কমে গেলে তা দেশের রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবরণীতে বলা হয়েছে, উন্নত দেশগুলোয় বিদ্যমান উচ্চ সুদের হার দেশের রিজার্ভ কমার অন্যতম প্রধান কারণ।
আগামী ৩০ জুন শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধিত রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৯ দশমিক এক বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত ৫ জুন রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে চলতি মাসের মধ্যে রিজার্ভে যোগ করতে হবে আরও চার দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার।
একই সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী—রিজার্ভের পরিমাণ ১৮ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার। এটি ২০২১ সালের আগস্টের ৪১ বিলিয়ন ডলারের অর্ধেকেরও কম।
বাংলাদেশের জন্য সুখবর হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো হয় সুদের হার কমিয়েছে অথবা স্থগিত রেখেছে।
গত বৃহস্পতিবার ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে। এটি প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম। গত বুধবার প্রথম জি-সেভেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে ব্যাংক অব কানাডা গত কয়েক বছরের মধ্যে ঋণ নেওয়ার খরচ কমিয়েছে।
সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ বছর সুদের হার কমিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ গত সেপ্টেম্বরে সুদের হার কমানোর পাশাপাশি এ বছর আবারও সুদের হার কমাবে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, 'বিশ্বজুড়ে সুদের হার কমলে তা দেশের রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করবে।'
গত ৮ মে বাংলাদেশ ব্যাংক ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট মেকানিজম তুলে নেয়। ডলার বেচা-কেনায় 'ক্রলিং পেগ' ব্যবস্থা চালু করে। এ চুক্তির আওতায় প্রতি ডলারে টাকার দাম ধরা হয়েছে ১১৭ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'আশা করা যায় যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার বা ক্রলিং পেগ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় তা শিগগির টাকার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করবে। তাই আগামী বছরগুলোয় রিজার্ভ বাড়বেও বলে আশা করা হচ্ছে।'
প্রতিবেদনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ব্যাংকিং খাতে শ্রেণিকৃত ঋণসহ অর্থনীতির সামনে সাত চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মূলত রিজার্ভ কমে যাওয়ায় ২০২২ সালের মাঝামাঝি ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে। এই অবমূল্যায়ন আমদানি খরচ বাড়িয়ে দেওয়ায় দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে সাত শতাংশ। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৪ দশমিক চার শতাংশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে টাকার দাম কমেছে ৩৬ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
গত বছর বলা হয়েছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের আশপাশে থাকবে। তবে মূলত টাকার দাম দ্রুত কমে যাওয়ায় তা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নয় দশমিক ৮৯ শতাংশে। আগামী কয়েক মাস এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।
যদিও উন্নত দেশগুলো যথাযথ নীতিগত উদ্যোগের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দামের লাগাম টানতে সফল হয়েছে, তবুও বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলো এখনো এ ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি ক্রমাগত কঠোর করার পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে দেশীয় কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা দিচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, 'এসব কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমবে। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তা পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
তবে সংকোচনমূলক মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
'কঠোর মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি ব্যবসায়ের পরিবেশকে কঠিন করে তুলছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি না কমলে বাজারে বিদ্যমান উচ্চ সুদের হার জিডিপিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে' বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়।
'শ্রেণিকৃত ঋণ ও আর্থিক শৃঙ্খলার অভাব সম্প্রতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে' উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের মতো পুনর্গঠন কর্মসূচি শেষ করার প্রয়োজন হতে পারে। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ ও কঠিন হবে।'
এতে আরও বলা হয়, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় আসার পর বৈদেশিক বাণিজ্যে সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, উৎপাদন বাড়ানো ও ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।